ক্যাকটাস্‌

নীলাঞ্জন মুখার্জী
0 রেটিং
997 পাঠক
রেটিং দিন
[মোট : 0 , গড়ে : 0]

পাঠকদের পছন্দ

সরকারদের পেল্লায় বাড়িটাকে পুরোপুরি পোড়ো বলা যায় না স্রেফ একতলার দক্ষিণের কোনের ঘরটার জন্য। পুরো বাড়িটার বারমহল অন্দরমহল ধসে গিয়ে ইঁট কাঠ রাবিশের স্তুপ আর সাপ ব্যাঙ ছূঁচোর আড্ডা। এক সময়ের প্রভাবশালী সরকারদের রাজা আর রাজত্ব আক্ষরিক অর্থেই সময়ের বহমান স্রোতে হারিয়ে গেছে। শুধু পড়ে ছিলেন তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকা একমাত্র ওয়ারিশ বিধবা সরলাবালা।

ওই দক্ষিণের একতলার কোনের ঘরে বুড়ি সরলা তাঁর তীব্র খ্যানখ্যানে গলার আওয়াজ, সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া শুচিবায়ূতাকে সঙ্গী করে একটা ফেলে আসা সময়ের শেষ প্রতিনিধি হয়ে দোর্দন্ডপ্রতাপে থাকতেন। তাঁর ভয়ে ও বাড়ি বেড়াল কুকুরও মাড়াত না। আনাগোনা ছিল বলতে শুধু চায়ের দোকানের হারুর – ফাইফরমাশ খাটা আর ঘরদোর ঝাঁটপালা দেওয়ার জন্য। সময়ে সময়ে বুড়ি মানুষের খোঁজ নিতে পাড়ার বয়স্থ সদস্যরা বার কয়েক চেষ্টা করেছেন ও বাড়ির চৌকাঠ মাড়ানোর। কিন্তু বুড়ির দুর্ব্যবহারে বাপ বাপ বলে পালাতে পথ পাননি। এই যেমন একবার জ্বর হয়েছে শুনে অমলবাবু আর সুকুমারবাবু অফিস ফেরতা গেছিলেন একটু খোঁজখবর নিতে। তা সুকুমারবাবু ঘরের চৌকাঠ ডিঙোতে না ডিঙোতেই পেটেন্টেড গলা সপ্তমে তুলে সরলা চিৎকার জুড়লেন, “দিলো, দিলো, আমার সব্বনাশ করে দিলো গো। ছাঁইপাশ মাড়িয়ে এসে বাসী জামা কাপড়ে ঘরে ঢুকে এল। এতটুকু কাণ্ডজ্ঞান যদি ভগবান দেন তোমাদের…ইত্যাদি ইত্যাদি”। এইটুকু বলে ক্ষান্ত থাকলেও বা কথা ছিল। ওই রাতেই দুজনকে দিয়ে হারুকে ডাকিয়ে গোবর জল দিয়ে ঘর মোছা করিয়ে আর একপ্রস্থ গালাগাল দিয়ে তবে শান্তি পেয়েছিলেন সরলা। স্বাভাবিক ভাবেই সেদিনের পর থেকে সরলাবালার ত্রিসীমানাতেও দুজন ভদ্রলোক আর যাননি। তারপর সেবার বাড়ির কালি পুজোয় জবা ফুল কম পড়েছে বলে মিত্তির বাড়ির ন্যাদা গেছিল লুকিয়ে সরকার বাড়ির জঙ্গল হয়ে যাওয়া বাগান থেকে কয়েকটা পঞ্চমুখী জবা তুলে আনতে। কপাল খারাপ, বুড়ির চোখে পড়ে গেল। ঝ্যাঁটার বাড়িটা এড়াতে পারলেও, ছুঁড়ে মারা হাওয়াই চপ্পলটা নিশানা ভুল করেনি। বাড়ি বয়ে এসে চোর ছ্যাঁচড় ইত্যাদি যা নয় তাই বলে ন্যাদার বাবাকে অপমান করতেও ছাড়েননি। দুপুর বেলার পর থেকে সরলা গেটের মুখে একটা মোড়ায় বসে থাকতেন। সুযোগ পেলেই উঠতি বয়সী ছেলে মেয়েদের ধরে তুমুল অশান্তি বাঁধাতেন, কোন ছেলে সিগারেটে টান দিচ্ছিল তো কোন মেয়ে ওপাড়ার বাঁড়ুজ্জেদের ছেলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। সময়ে সময়ে বাড়ি বয়ে এসে বাবা মাদের কথা শোনাতেও পিছপা হতেন না। কত যে ছেলে ছোকরারা বাবা মাকে লুকিয়ে বাঁদরামো করতে গিয়ে তাঁর কাছে ধরা পড়েছে আর তারপর বাড়িতে উত্তম মধ্যম খেয়েছে তার কোনও ইয়ত্তা নেই। সেকেলে বিধবাদের ছোট করে ছাঁটা খাড়া খাড়া চুলের সঙ্গে মিলিয়ে পাড়ার ছেলে মেয়েরা সরলার নাম দিয়েছিল ক্যাকটাস্‌, হাতের নাগালে গেলেই কাঁটা মারতে ছাড়বে না। 

দক্ষিণপাড়া থেকে রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিয়ে স্টেশনের দিকে চলে গেছে, ঠিক সেই মোড়ে সামনে পিছনে বিস্তর জমি নিয়ে তৈরি হয়েছিল সরকারদের বাড়ি। এখন আছে শুধু সামনে ঝোপ ঝাড় আর আগাছায় জঙ্গল হয়ে যাওয়া খানিকটা বাগান আর এককালের সাতমহলা বাড়ির ধ্বংস স্তুপ। বাড়ির বাহারি গেটের নক্সাটাও  এখন আর কারুর মনে নেই। পড়ে আছে শুধু গেটের দুটো থাম আর বাউণ্ডারির পাঁচিলের টুকরো টাকরা। বাকি জমি জিরেত বিক্রি হয়ে গিয়ে ছোট ছোট দু-তিন তলা বাড়ি উঠে গেছে সে কবেই। সেই সব বাড়ির বয়সও খুব কম হলনা। প্রায় দু’পুরুষ কেটে গিয়ে সেই মুখুজ্জে মিত্তির সেন বাড়িই আজ এ তল্লাটের আদি বাসিন্দা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতার হাওয়া এসে লাগলো এই ছোটো ছাপোষা মফস্বল শহরটাতেও। স্টেশন চত্তরে গজিয়ে উঠল বার কাম রেস্টুরেন্ট, একমাত্র সিনেমা হলটা ভেঙ্গে হল “শীতলপুর মার্কেট”, আমতলার মাঠটা বিক্রি হয়ে গিয়ে জন্ম নিল শীতলপুরের প্রথম চারতলা ফ্ল্যাট “প্রগতি হাউসিং কমপ্লেক্স”। সেও হয়ে গেল আজ প্রায় বছর দশ। ঘণ্টাখানেকের লোকাল ট্রেনের দূরত্বের বড় শহরের ক্রমবর্ধমান জনজোয়ারের ঢেউ ক্রমশই ছড়িয়ে পড়তে লাগল শীতলপুর আর তার আসে পাশের শহরতলিতে। “চিরকালের চেনা লোকের” শীতলপুরে অচেনা মানুষের সংখ্যা এখন অনেক বেশি। আধুনিক সভ্যতার স্রোতের সঙ্গে অবশ্যম্ভাবী আবর্জনাও এসে জুটেছে ভাল পরিমাণেই। যে শীতলপুরের মানুষ ছিঁচকে চুরি আর মাতলামির বেশি কোনও দিন কিছু দেখেনি তারা এবারে পরিচিত হল, ডাকাতি, তোলাবাজি, ছিনতাই, এমনকি দু’একটা রাজনৈতিক খুনের সঙ্গেও। 

এই পালাবদলে অবশ্য সরলাবালার কিছু এল গেল না। বেশ কিছুদিন আগে এক প্রোমোটার এসেছিল বটে বাড়ি কেনার প্রস্তাব নিয়ে, সরলা কি বুঝেছিলেন তা জানা নেই, তবে খ্যাংরা উঁচিয়ে তাড়া করার পর আর কেউ ওপথে হাঁটেনি। তাঁর বয়স যে এখন কত, তা সম্পর্কে কারুর সম্যক ধারণা নেই। কেউ বলে আশি, কেউ বলে নব্বই। হারুর এখন নিজেরই চায়ের দোকান, আর তার বউ সরলার ঘরদোর ঝাঁটপালা দেয়। সুকুমারবাবু মারা গেছেন বেশ কিছুদিন। ন্যাদা চাকরি করে ভিন রাজ্যে। সরলাও হয়ে পড়েছেন অশক্ত, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে অনিদ্রা রোগ। তবু সময়ের জালে জড়িয়ে যাওয়া স্মৃতির পর্দায় তিনি এখনও তাঁর দাদাশ্বশুরের আদরের নাতবৌ। সরকার বাড়ির শেষ প্রতিভু হিসেবে পাড়ার লোকেদের দেখাশোনা করা, ঠিক পথে রাখার দায়িত্ব যেন তাঁরই। সে ছাই কেউ তাঁকে মানুক আর নাই মানুক। আধুনিক ছেলে মেয়েদের বেহায়াপনা দেখলে তাঁর গা রি রি করে ওঠে। কিন্তু দিনকাল বদলেছে, আর তাঁর শরীরেও ক্ষমতা নেই, ছেলে ছোকরাদের পিছু তাড়া করার। এখন গেটের মুখ থেকেই তিনি চিৎকার করে গালাগালি শুরু করে দেন – “মরণ হয় না বেহায়া ছুঁড়ির, ব্যাটাছেলেদের জামা কাপড় পরে রাস্তা দিয়ে গ্যাটম্যাট করে যাচ্ছে…” বা “বাপ মা গুলোর কোনও হুঁশ নেই গা, ছেলেমেয়ে গুলো নির্লজ্জ বেহায়ার মত রাস্তায় প্রেম করে বেড়াচ্ছে…”। এতে আজকালকার ছেলেমেয়েদের বিশেষ কিছু হেলদোল না হলেও, সরলার ক্যাকটাস্‌ নামটা টিঁকে গিয়েছিল। তবে তাতে ভয়ের পরিমাণটা কমে গিয়ে জমেছিল টিটকিরি। রসকষহীন কাঁটায় ভরা মরুভূমির মাঝে বছরের পর বছর ধরে বেঁচে থাকা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় এই উদ্ভিদ শ্রেণীটির সঙ্গে তারা সরলাবালার আশ্চর্য মিল পেয়েছিল। মুখুজ্জেদের ছোট মেয়ে নীহারিকা পাশের বাড়ির সুজাতার সঙ্গে জীন্স আর টপ পরে সাইকেল নিয়ে পড়তে যাওয়ার পথে সরলা বুড়ির বাড়ি থেকে ঢিল ছোঁড়া দুরত্বে রোল সেন্টারে দাঁড়িয়ে খাওয়ার সময়ে পাড়া কাঁপানো খ্যানখ্যানে আওয়াজে যখন সরলাবুড়ির শাপশাপান্ত আর বাপবাপান্ত শুনতে পায় তখন নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করে আর গলা উঁচিয়ে জবাব দেয় – “ক্যাকটাস্‌ ঠাকুমা, খাবে নাকি একটা। খেয়ে দেখ, মেজাজ খুশ হয়ে যাবে”। তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে সরলা আরও তিনগুণ জোরে চিৎকার করেন – “খা না খা, খেয়ে ওলাউঠা হয়ে মরবি। ও রকম ব্যাটাছেলের মত নাচন কোঁদন ধিঙ্গিপনা করলে কোনও দিন তোদের বাপ মা বর জোটাতে পারবে না রে বেহায়া মেয়েছেলে। খ্যাংরা দিয়ে সব বিষ ঝেড়ে দিতে হয়।” সরলার কাছে, আইবুড়ো মেয়েদের বর না জোটাটাই তখনও ছিল চরম অভিশাপ। একথা শুনে, হি হি করে হাসতে হাসতে সাইকেলে উঠে দুজনে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে আওয়াজ দিয়ে যায় – “বাপ মার দরকার নেই গো ঠাকুমা, আমরাই জুটিয়ে নেব”। জবাবে সরলা কি বলেন সেটা চাপা পড়ে যায় কোনও এক মোটোরবাইকের প্রবল আওয়াজে।

সেদিনটা ছিল বাদলা। আসন্ন নিবার্চনকে ঘিরে শহরের বুকে হয়ে গেছিল একপ্রস্থ বোমাবাজি। চারদিক থমথমে, আর তার মধ্যেই নাইট শোয়ের সিনেমা দেখে নীহারিকা আর সুজাতা ফিরছিল রাত প্রায় এগারোটায়। এগিয়ে দেওয়ার জন্যে সঙ্গে ছিল, সুজাতার বয়ফ্রেন্ড তমাল। মোড়ের মাথায় আসতেই রাত জাগা চোখে বসে থাকা সরলা ঝাঁপিয়ে পরেন তিনজনের ওপরে। হাতে ধরা ত্যাড়াব্যাঁকা লাঠিটা দিয়ে একরকম তাড়া দিতে দিতে গিয়ে পৌঁছন নীহারিকা সুজাতাদের বাড়ির সামনে। তাঁর উৎসাহ আর গলার জোর দেখে কে বলবে যে তিনি একজন অশীতিপর বৃদ্ধা। দুই বাড়ির বাবা মাদের সামনে তাদের মেয়েদের চরিত্র নিয়ে রীতিমত প্রশ্ন তুলে পাড়া জাগিয়ে তিনি যা কাণ্ডটা বাঁধালেন তার নীট ফল হল চরম। সুজাতার বাড়ি থেকে বেরোন বন্ধ হয়ে গেল দীর্ঘদিনের জন্য। তমালের বাড়িতে ফোন গেল, এবং দু পক্ষ থেকেই বিস্তর গালি গালাজ খেয়ে বাবার কড়া নজরদারিতে পড়ে গেল সে। বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে আড্ডা মারা টোটালি বন্ধ। প্রবল চিৎকারের পরে সরলাকে শান্ত করে নীহারিকার বাবা সরলাকে বাড়ি ছাড়তে যাওয়ার পথে কি কথাবার্তা হয়েছিল জানা নেই, তবে দাদার সঙ্গে ছাড়া নীহারিকার বাড়ি থেকে বেরোন বন্ধ হয়ে গেল। তার পোশাক আশাক, বন্ধু বান্ধবের তালিকা পড়ে গেল কড়া স্ক্রুটিনিতে। মেয়েগুলোর বিশেষ কিছু করার না থাকলেও, তমাল ঘটনাটা হজম করল না। তার বন্ধুদের সঙ্গে মিলে নিল নির্মম প্রতিশোধ। 

দুপুরবেলা বাড়ির পেছনের কুয়োতলায় সরলা চান করতেন। চান করার পর গোবর জল দিয়ে কুয়োতলা পরিস্কার করে, হাতে গোবর লেগেছে বলে আবার চান, আর তারপর আবার পরিস্কার। ক্রমাণ্বয় এক অসীম আবর্তের মত ঘটে যাওয়া এই পর্যায় মিটতে মিটতে কেটে যেত দু থেকে তিন ঘণ্টা। এই সময়টাতেই, এক রবিবার তমাল আর তার দলবল বাড়িতে ঢুকে দা দিয়ে কাটা ফণিমণষার ঝাড় পেতে দেয় বুড়ির দোরগোড়ায়। চোখে ছানি নিয়ে সরলা দেখতে পাননি। পা দিয়ে মাড়াতেই, পাঁচটা কাঁটা আমূল ঢুকে যায় পায়ের পাতায়। বাড়িটা একটেরে এবং ঘটনাটা ভর দুপুরে হওয়াতে প্রবল আর্তনাদটা কারুর কানে হয়ত যেত না, যদি না ঠিক সেই সময়েই হারুর বউ, সরলাকে বাপের বাড়ি থেকে আসা গাছপাকা লিচুগুলো দিতে না আসত। কিছুক্ষণের মধ্যেই হারুর বউ লোকজন জুটিয়ে ফেলে প্রাথমিক ব্যান্ডেজটা বেঁধে দেয়। পাড়ার এমবিবিএস, ফিরোজ চৌধুরী বিধর্মী হওয়াতে সরলা তাঁকে ত্রিসীমানায় আসতে দেবেন না। অগত্যা, হারু স্টেশন পাড়া থেকে ডাক্তার ব্যানার্জ্জীকে ডেকে আনে। জুতো ছেড়ে, পা ধুয়ে বামুন ডাক্তারবাবুকে ঘরে ঢুকতে দিতে সরলা যদিও বা রাজী হন, বিপত্তি বাঁধল চিকিৎসা করতে গিয়ে। একটা কাঁটা বেশ গভীরে ঢুকে যাওয়ায়, ডাক্তারবাবু বলেন, গোটা তিনেক সেলাই লাগবে। কিন্তু সে তো হওয়ার নয়। প্রথমত, সরলা শুনেছিলেন যে বেড়ালের নাড়িভুঁড়ি দিয়ে ডাক্তাররা সেলাই ফাঁড়াই করেন। অনেক কষ্টে যদি বা রাজী করানো গেল, সরলা কিছুতেই সেলাইয়ের ছুঁচ তাঁর গায়ে ঠেকাতে দেবেন না। তাঁর এক দাবী, ডাক্তারকে গোবর দিয়ে ছুঁচ শুদ্ধ করে তবে সেলাই করতে হবে। স্বাভাবিক ভাবেই ডাক্তারবাবু এই ভয়ংকর ইনফেকশনের পথে হাঁটতে রাজী হলেন না। যার ফলে, শেষ পর্যন্ত আদ্ধেক চিকিৎসা করেই তাঁকে ক্ষান্ত দিতে হল। আস্তে আস্তে ঘা শুকিয়ে গেলেও, বাঁ পাটা পুরোপুরি জখম হয়ে যাওয়ায় সরলা নিজের ঘর আর কলতলাটুকু ছাড়া আর কোথাও চলতে ফিরতে পারতেন না। নিষ্ঠুরতার প্রতি তারুণ্যের স্বাভাবিক আকর্ষণে, তমাল সুজাতারা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করল – “ক্যাকটাসের ডাল ছাঁটা গেছে”। এই ঘটনার পর সরলা আর ঠিক এক বছর বেঁচে ছিলেন।

সরলার ইহলোকের পর্ব সাঙ্গ হওয়ার পরে যখন জীবনের স্বাভাবিক গতিধারায় হারু আর হারুর বউএর শোক কমে এসেছে, যখন ছেলে ছোকরারা আস্তে আস্তে ভুলে এসেছে ক্যাকটাস বুড়ির কথা তখন হঠাৎই একদিন দেখা গেল সরকার বাড়ির কোনের ঘরে গজিয়ে উঠেছে “তরুণ সঙ্ঘ”। ঝড়ের গতিতে ছুটে চলা দৈনন্দীন জীবনে ব্যস্ত থাকা পাড়ার মানুষগুলোর মাথা ঘামানোর সময় ছিল না সরকার বাড়ির ভবিষ্যত নিয়ে। বে-ওয়ারিশ এই বিশাল বাড়ি আর জমি পড়ে ছিল জবর দখল হওয়ার অপেক্ষায়। রাজনৈতিক রেষারেষিতে জয়ী পক্ষের বিজয় কেতন ছিল তরুণ সঙ্ঘ। ভারী ভারী চেহারার সাইলেন্সর খোলা বাইকের সশব্দ আনাগোনা, বিকট শব্দে মাইক বাজিয়ে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা বিশ্বকর্মা পুজো, সন্ধে হতেই গাঁজার গন্ধে ভারী হয়ে ওঠা বাতাস, রাস্তায় পরে থাকা মদের বোতলের ভাঙ্গা টুকরো আর রাস্তা দিয়ে চলে যাওয়া মেয়েদের দিকে মাঝে মাঝে হঠাৎ ছুঁড়ে দেওয়া চটুল হিন্দি গানের কলি – দক্ষিণপাড়ার ঈশান কোণে মেঘ জমছিল ধীরে ধীরে। এখন নীহারিকা নিজেই দাদাকে বলে একটু এগিয়ে দেওয়ার জন্য। নারী-স্বাধীনতা শিঁটিয়ে যায় শীতল চোখের লোলুপ চাউনির সামনে। আধুনিক সভ্যতা যেন কোনও গণতান্ত্রিক ভোটের গ্যাঁড়াকলে জড়িয়ে গিয়ে নিরাপত্তার নিয়ে পৌঁছতে পারে না পাড়ার মানুষগুলোর কাছে। রোল সেন্টারে খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে নীহারিকা বেশ কিছুদিন হল।

সেদিনটাও ছিল বাদলা। সেদিনও নীহারিকার ফিরতে দেরি হয়ে গেছিল অনেকটাই। তফাত বলতে নীহারিকা ফিরছিল বন্ধুর বিয়ে থেকে আর দেরিটা হয়েছিল আগের স্টেশনে হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা রেল রোকোর জন্য। আর সবথেকে বড় ব্যাপার হল, নীহারিকা ছিল একা। সুজাতার বিয়ে হয়ে গেছে মাস তিনেক হল। কলেজ শেষ করে দাদা চাকরি নিয়ে পুনেতে। স্টেশন থেকে সাইকেলটা প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার সময়ে নীহারিকার মনে পড়ে, জ্বরে কাবু বাবাও সম্ভবতঃ নিতে আসতে পারবে না সরকার বাড়ির মোড়ে। খানা খন্দ বাঁচিয়ে যতটা স্বম্ভব জোরে প্যাডেলে চাপ দিয়ে হারুর বন্ধ চায়ের দোকানের সামনে পৌঁছতেই ঝপ করে লোডশেডিং। কিছু আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর ওঠা একটা মরা চাঁদের আলোয় চোখটা সইয়ে নেয় নীহারিকা। বাঁ দিকে ভুতের মত দাঁড়িয়ে আছে মিত্তিরদের বাড়িটা। বাড়ি বিক্রি করে বাবা মাকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোর চলে গেছে ন্যাদা। কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙে ফ্ল্যাট বাড়ি উঠতে শুরু করবে। আরও খানিকটা যেতে চোখে পড়ে সরকার বাড়ির চৌহদ্দী। হঠাৎই নীহারিকার মনে পরে এমনই এক রাতে সরলা বুড়ির সঙ্গে ঝামেলার কথা। আজকে দীর্ঘদিন পরে প্রবল ভাবে মনে পরে ক্যাকটাস্‌ ঠাকুমার কথা। আজ যদি সে অন্ধকার রাস্তার মোড়ে হাতে লণ্ঠন নিয়ে অষ্টাবক্র লাঠি হাতে কোন বুড়িকে তার নামে শাপমণ্যি করতে শুনতো, নির্ভয়ে চলে যেতে পারত বাকি রাস্তাটা। কিন্তু আজ মোড়ের মাথাটা নিকষ অন্ধকারে মুখ ঢেকে আছে। সরকার বাড়ির ভাঙা গেটের ঠিক সামনে নীহারিকার সাইকেলের সামনের চাকায় জড়িয়ে গেল নির্ভুল ভাবে ছোঁড়া একটা গাছের ডাল। বিন্দুমাত্র সামলানোর সময় না পেয়ে, ছিটকে পড়ল নীহারিকা। জীন্সের পকেট থেকে ছিটকে গেল মোবাইলটা। প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে উঠতে না উঠতেই পেছন থেকে কেউ ঠান্ডা গলায় বলে উঠল – “এ হে হে, মামণি কি পড়ে গেলে নাকি”। শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হীম শীতল স্রোত বয়ে গেল নীহারিকার। ধরফরিয়ে উঠতে গিয়ে টের পেল, গোড়ালিটা মচকে গেছে সাংঘাতিক ভাবে, কনুইতেও অসম্ভব ব্যাথা। মুখটা তুলে দেখতে পেল আস পাশ থেকে এগিয়ে আসছে কতগুলো কালো কালো ছায়া। রাস্তার ওপর মোবাইলটার স্ক্রীনে চাঁদের আলো পড়ে চকচক করছে দেখে নীহারিকা হাত বাড়ায়। ছুটে এসে একটা ছায়ামূর্তি লাথি মেরে সরিয়ে দেয় ফোনটা – “অত তাড়া কিসের সোনামণি”। চারদিক দিয়ে হিংস্র হায়নার মত এগিয়ে আসতে থাকে তারা। লীডার এসে উবু হয়ে বসে নীহারিকার পাশে। সস্তা মদ আর গাঁজার গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে নীহারিকার। “বড্ড লেগেছে রে। চ, ক্লাব ঘরে নিয়ে গিয়ে একটু মাসাজ টাসাজ করে দি”। লালসায় ভরা চাপা গলায় খসখসে অশ্লীল হাসিতে ফেটে পড়ে বাকিরা। “গুরু, চাম্পি মাল। একটু প্রসাদ দিও কিন্তু”। অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে নীহারিকা বলে ফেলে – “ছেড়ে দিন, প্লীজ”। হারুদার টিনের চালের বাড়িটা খুব একটা দূরে নয়। একবার যদি বাঁচাও বলে চিৎকার করে, যদি কোনভাবে কেউ শুনতে পায়? কি ভাবে যেন বুঝতে পারে তরুণ সঙ্ঘের বস। বাঁ হাতে নীহারিকার চুলের মুঠিটা ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে মাথাটাকে পিছনে হেলিয়ে দিয়ে ডান হাত দিয়ে একটা থাবড়া মারে মুখে। ঠোঁটটা কেটে গিয়ে রক্তের নোনাস্বাদ জিভে পায় নীহারিকা। নীহারিকার থুতনিটা ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে হিসহিসিয়ে বলে ওঠে, “একটা আওয়াজ করলে এমন জায়গায় চালান করে দেব না, সারা জীবন সিলিং ফ্যান দেখবি আর খদ্দের সামলাবি হারামজাদী”।

Violence against childrens

আকাশে একটুকরো মেঘের আড়ালে মুখ লুকোয় মরকুটে চাঁদটা। নতুন করে জমে ওঠা অন্ধকারের মধ্যে একটা হাল্কা হাওয়া এলোমেলো ভাবে কোথা থেকে যেন বয়ে আনে সদ্য গোবর নিকনো ঘরের সোঁদা গন্ধ। হায়নাগুলো জোরে শ্বাস নিয়ে বলে, “কিসের গন্ধ রে”। নিস্তব্ধ গুমোট রাতে হু হু করে ছুটে আসে একটা ঘুর্ণি ঝড়। পচা পাতা আর ভেজা ধুলো পাক খেয়ে ওঠে মাটি থেকে। আচমকা এই আক্রমণে ছিটকে যায় শয়তানগুলো। তারপরই ছুটে আসে কাঁটার ঝাঁক। ছোট বড় ফণিমণষার ডাল উড়ে এসে ঘুরপাক খায়। আমূল বিঁধে যায় তরুণ সঙ্ঘের সদস্যবৃন্দের চোখে, হাতে, গলায়, পিঠে, ঘাড়ে, মাথায়। নীহারিকাকে ছেড়ে দিয়ে তারা তখন ব্যস্ত দু হাত দিয়ে নিজেদের বাঁচাতে। ক্রমশই যেন বাড়তে থাকে ঝড়ের দাপট আর কাঁটার আক্রমণ। এবারে আর্তনাদ করে ল্যাজ গুটিয়ে দৌড় শুরু করে ওরা। ওদের সেই হাহাকার চাপা পরে যায়, পাগলা হাওয়ায় ভর দিয়ে আসা একটা তীব্র খ্যানখ্যানে গলায়, – “মেয়েমানুষ দেখলেই নোলা সকসক করে ওঠে নারে মুখপোড়ার দল। এতদিন ধরে আমার ঘরে বসে মদ মাংস গিলছিলি, কিছু বলিনি। এত বুকের পাটা যে এখন আমার মেয়েদের গায়ে হাত দিবি হারামজাদা। চোখ দিয়ে লালা ঝরে তোদের, চোখ গেলে দেব না…”। এক থেকে দু মিনিটের মধ্যে শুনশান রাস্তার মাঝে গায় হাতে পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে একা নীহারিকা পড়ে থাকে। গোলমাল হট্টগোল শুনে হারুদার বাড়ির দরজা খুলে টর্চ হাতে ছুটে বেরিয়ে আসে হারুদা আর বউদি। নীহারিকাকে ধরে বসিয়ে হারুদা বিহ্বল ভাবে বলে ওঠে – “কি হয়েছে গো দিদি? আমি যেন পষ্ট শুনলাম পিসির গলা”। নীহারিকা কোনমতে বলে, “আমাকে একটু বাড়ি পৌঁছে দেবে হারুদা”।

সরকারদের পেল্লায় বাড়িটাকে পুরোপুরি পোড়ো বলা যায় না স্রেফ একতলার দক্ষিণের কোনের ঘরটার জন্য। ঘরটা থেকে তরুণ সঙ্ঘের শেষ চিন্হটুকু মুছে ফেলে ভাল করে চুনকাম করিয়ে গোবর জল দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে ফেলেছে দক্ষিণপাড়ার লোকজন। শহর থেকে প্রশিক্ষক এনে সেই ঘরেই এখন শুরু হয়েছে মেয়েদের আত্মরক্ষা শেখানোর স্কুল। সামনের জঙ্গলটা খানিকটা সাফ করে তৈরি হওয়া খোলা মাঠটায় এখন রোজ বিকেলে জুডো শেখে নীহারিকারা। আশপাশের বাকি বাগান আর ভাঙ্গা বাড়ির ভেতরটা ভরে গেছে ফণিমণসা সহ বিভিন্ন ধরণের ক্যাকটাসে। সে কেউ পরিষ্কার করে না। ঊষর মরুর মাঝে, যুগ যুগান্ত ধরে শক্ত কাঁটার সুরক্ষ্মায় মোড়া কোমল অন্তঃস্থল আর কোন গাছ রাখতে পারে? 

ও বলা হয়নি, নীহারিকারা ওদের জুডো স্কুলের নাম রেখেছে – ক্যাকটাস্‌।

চিত্র সৌজন্য : গুগল

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

রেটিং ও কমেন্টস জন্য

নতুন প্রকাশিত

হোম
শ্রেণী
লিখুন
প্রোফাইল